নূতন ঈশ্বর
আহ্, আজ আবার
মানুষ বিকিয়ে দিয়ে ঈশ্বর কিনেছি,
ধনাধিপ মনুষ্যত্বের বদলে এনেছি
ধনার্থী প্রভূত্বের পাহাড়।
তাই কেউ প্রশ্ন করলে বলি—
মেনেছি যে ঈশ্বরের কঠীন আদেশ
সফল জেনেছি তা— সেখানেই সব প্রশ্নের শেষ;
শাশ্বত শক্তিতে বিশ্বাস
তার অটলতায় সে শক্তিকেও ডিঙিয়ে যায়,
আর যত আর্তনাদ, লাশ
মানবের মাঝে রোজ গুরুত্ব হারায়,
তাও সেই নিত্য সংহারে-
সংঘর্ষে তোমাতে আমাতে,
তোমার ঈশ্বরে আর আমার ঈশ্বরে।
এই তো ক’দিন—
ত্বকহীন হাড়সর্ব নেড়ীর মতন
আমাদেরও জিভ তারপর পা ছোঁবে।
যুদ্ধ সব শেষ হবে,
জিহ্বার লকলকে লোহিত আগুন
পোড়াবে স্রষ্টার সৃষ্টি
আর সৃষ্টির ভ্রষ্ট স্রষ্টাদের। পোড়াবে।
সেই তাপে,
পবিত্রতার সংজ্ঞা দেব নূতন পাপে,
আর যা আছে শুদ্ধ
যা কিছু মহান, চির, তাতে
নিত্য বিদ্ধ হবে শুদ্ধতর ক্ষুধায় ভিক্ষায়
পুরাতন বিধি ও বিধাতা।
আজ এই গুমট বাধা রাতে
আমি চেয়ে আছি সেই আগামীর আগুনের পানেঃ
ঝাপসা চোখের আগে পোড়ে
ধর্ম, প্রেম, শতাব্দীর দর্শন—
যত কিছু যত্নে পুষেছিল অভিজাত মন
দেহের তৃষ্ণার আগে সব আজ- নিতান্ত উঞ্ছ বাঞ্ছা কিছু—
দেহ কই, জিভ্ শুধু—
লকলকে শিখার মতন
পোড়ায় পূজার থালা, দধীচির হাড়, আর
তোমার আমার ক্ষুদ্র মন।
কান-ফাঁটা হাওয়া-কাটা মত্ত চিৎকারে
চোখ বুজি। ভয় হয়, এ জ্বলন্ত চিতা
আমারই চোখের নয়তো?
অথবা, হয়তো,
এ আগুনই দেখেছিল পিতা, পিতামহ, তারও পিতা!
আমাদের বাড়ন্ত জিভ্
তারও চোখে পড়েছিল?
তাই দিতে চেয়েছিল
স্রষ্টার সৃষ্ট জগৎ?
মানবসৃষ্ট স্বর্গ চেয়ে আমরাই কেবল
জ্ঞান কুড়িয়েছি, হয়েছি মহৎ
ধংস আর হননের হাতে
নিজেদের তুলে দিয়ে
আগলেছি কোন এক ইতর ঈশ্বর!
তার তরে আমার ইতরতর মন
নবতর পূজ়ার করছে আয়োজন,
গুমোট জমাট বাধা রাতে।
২৫ জুলাই, ‘০৮
রাত
চলো আজ রাতটা বরং
দুজনেতে ভূত তাড়াই।
আমাকে চেনোই
খবরের পাতা আমার আঙুলে মানায় না—
দুনিয়াটাই উলটে যাক না
আমার টেবিলের ওই পাতাগুলোর চেয়ে!
তবু ওই
ভূত আসা চাই।
কুঁজো পিঠ একটু হেলান দিলেই
তাদের সজোড়ে এসে কিল মারা চাই।
আজ আর খাবারের আয়োজন করো না।
খাবারের দলাগুলো আস্তে আস্তে
রাস্তায় পড়ে থাকা ঘিলু হয়ে যায়...
আর কে পায়—
মাথার পেছনে সেই ভূতের বহর
ক্ষিপ্র মিছিলে প্রস্তুত।
কেউ আসে লাশ দেখতে
কালো জলের লাশ।
লাল দাঁত হেসে ফেলে,
“বলি ছ্যার্, ভাসি আসছে,
আমাদের থানার ত নয়।”
আমাদের পরিচয়
আজ তবে হয়ে যাক নতুন করে?
এসো বসি
একটু অন্ধকারে।
মিলনের আজ আর প্রয়োজন নেই
উষ্ণ আমার দেহে আরামের আভা চলে এলে
কমলাপুরের কোণে বাচ্চাটা কেঁদে জেগে ওঠে,
“অ বাযান, ছালাডায় বড় বেশি শীত ঢুহে—”
“ঘুমা বেডা! সগিরের দুকানের টিবিত্ দেহস্?
হ্যাগো দ্যাশে এরাম মাসে বরফ লামে।”
বরফ নামে আমার জানালায়
হাস্যকর সান্তনায়
দগ্ধ চোখের কোণে বরফ গলে।
চোখ নয়, জ্বলন্ত জানালা—
আজ রাতে আমার শরীর
তীব্র যন্ত্রণায় মোনী বন্দি দালান।
আমার মুক্তি নেই
মিলনের তপ্ত শ্বাস
আজ রাতে ধোঁয়া হয়ে যাবে।
আমার স্বস্তি নেই
দূরে, খুব দূর কোন দেশে
সহস্র ভূতেরা নাচে আমার ঘুমের জবাবে।
পলাতকা
কোন এক একলা জানালায়,
অকপট যৌবনে দূরদেশী কোন মেয়ে
স্বপ্ন দেখেছিল—
বাড়ি ফিরবে গলা খুলে গান গেয়ে।
দেখলে তাকে গলা টিপে ধোরো,
পিছপা হয়ো না আর।
জন্ম যার চিৎকারে,
সঙ্গীতের অধিকার
কে কবে দিয়েছিল তারে?
গলা চিরলে দেখতে পাবে
তার রক্ত লাল নেই।
তার রক্ত বিষের চেয়ে নীল।
জীবনানন্দ, তোমার সোনালী ডানার চিল
তাকে আর ডাকে না—
তোমার ভেজা মেঘ, মাঠ, পথ,
চাইলেও চিনতে পারে না তাকে।
তবু জীবনের কোন এক ফাঁকে
নিয়েছে সে বাঁচার- বাঁচতে চাওয়ার- শপথ।
তাই আজ যখন
পুড়ছে তোমার ক্লান্ত পতাকা,
দূরে হাসে, দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাসে,
ঘরছাড়া এক মৌনী পলাতকা।
৭ জানুয়ারি, ২০১৪
অকবিতা
দু পাশে দু জানালা পৃথিবী দৌড়ে চলে যায়—
ছোট ছোট শহর আর শহরের আভাস
ছুটে যায় বিচ্ছিন্ন স্বপ্নের মতন
দ্রুত সরতে থাকা ইটের শিয়রে
একলা চাঁদটা ছাড়া।
কিছু বছরের চর্চাহীন পিছুটান
হঠাৎ কিসের ডাকে জড়ো হয় আড়ষ্ট ভাঁজে,
খানিক জায়গা দেই কোলের ওপরে বইয়ে
উড়ন্ত পাতায়, অচেনা শব্দে, পুরনো চায়ের দাগে।
ঘন হতে থাকা রাতের নীলটা
গলা টিপে ধরবে এখনই।
এখানে একলা কিছু অরণ্য আছে
পর্যটন ভিড়ে যারা অসহায় মাটি
পেতে দেয় কিশোর-কিশোরী দল
ক্যাম্পিং করবে বলে।
তবুও একাকি
বসে থাকে সূর্যহীন শীতের গুহায়
নিরুপায় বৃক্ষের দল।
কিছু কিছু সবুজেরা অনায়াসে খুঁজে নেয় পথ
শহরের কোণায় কোণায়—
এ শহরে তারা আর নয় আগন্তুক।
কিন্তু আমাকে
যে শহর ডাকে তার হাজার নিয়ন নয়নে
সেখানে সবুজগুলো হেলার ধুলায়
খয়েরি বাতাস ফুঁকে ক্রমশ ফেকাশে হয়ে আসে।
আমার পাঁজরে তার আধখেঁচড়া সুতো
টাবের ড্রেনের গায়ে অবাঞ্ছিত চুলের মতন ...।
ছুটে চলা ফিটফাট শহরে
নড়েচড়ে বসে কিছু খোঁচাখুঁচি শুরু করি
বিরক্ত শব্দগুলোতে।
ভিতরের কবিতার কবরস্থানটাও
একটু কুয়াশা টেনে আনে,
এ রাতের প্রস্তুতি যদি
প্রার্থিত ভূত নিয়ে আসে!
কিন্তু এখন বোধহয়
আগলে ধরতে পারি না,
আঁকড়ে ধরতে পারি না— আমার অনভ্যস্ত বুক
বোধহয় অতটা আরামসই নয়।
যে শহর আজ শুধু ইতিহাসের অট্টহাস্য হয়ে
ময়লা দাঁতের ফাঁকে পানের পিকের মত রক্ত লুকায়,
আমার কবিতা ছিল সেইখানে অন্ধকারে অলিতে গলিতে
বাঁধভাঙা বৃষ্টিতে
সেখানে আমাদের ছিল লাজুক মিলন।
এখানের ঘামহীন অলস রাতেরা
তাই শুধু এলোমেলো দুঃস্বপ্নের স্থান,
গুনে গুনে গুঁজে রাখা নিকেলের টান আর
মাথার পেছনে কিছু শব্দের ধ্বংসস্তূপ স্রেফ।
ভাবনাভীড়ে আটকে থাকা একটা কি দুটো ছেড়া লাইন...
আর নেই।
আর কিছুই নেই নিজেকে দেয়ার।
৩০ মে, ২০১২
নেক্রোফিলিয়া
আজও আমি ভাসছি।
আমার একটু দূরে মেকি ঘুমে নাক ডাকছে শহর।
আমি শান্ত নই।
মানবের আজন্ম পাপের তুমি যে ঈশ্বর,
তোমার নরকের এত অন্ধকার লুকানোর
যথেষ্ট রাত আমার নেই।
ঢেউয়ের কোলে আজও ভাসছে লাশ-পোড়া গন্ধ।
আমি সুস্থ নই।
তোমার বুকের চাপে গুঁড়ো হয়েছে
আমার সব শুকনো কান্না —
তোমার কামান্ধ চোখের আগুনের তলে
আমি পুড়েই চলেছি তুমি দেখো নি।
তোমার পুজার যজ্ঞে যত লাশ স্তূপ হয়ে আছে
তাদের সনাক্ত করতে যথেষ্ট স্বজনও আর নেই।
তোমার শিশ্নে বিদ্ধ আমার শরীরে
দাগ কাটবার জায়গা নেই আর।
আজও এখনো ভাসছে মাঝির কান্না-ভরা গান —
“বিধি রে, তোমার খেয়ালের শেষ নাই
দয়া নাই তোমার মায়া নাই...”
বিধির এ খেয়ালের তুমি যে বিধাতা,
তোমার খেয়ালের জন্য যথেষ্ট দুঃস্বপ্ন আমার নেই।
আজ আমার মুখে এক পূর্নাঙ্গ নাগরিক জিভ —
নাড়লে তাতে লালা ঝরে, কথা ফোটে না।
২৭ ডিসেম্বর, ‘১২
ওরা
ওই যে ওরা জন্মাচ্ছে প্রতিদিন,
ওদের কান্নায় আমরা চিৎকার করে উঠছি না,
আমরা আঁতকে উঠছি না ওদের চোখের লাল রঙে।
খুব দ্রুত শিখে যাবে ঠোঁটে আঁকতে নকল হাসি,
আমরা বাহবা দিচ্ছি সেই স্বপ্নীল সম্ভাবনায়।
প্রতিদিন বেড়েই চলছে লালা ঝরানো জিভ,
দিন দিন লাল থেকে আরো লাল হচ্ছে চোখ,
স্বাধীনতার আগুনে তো নয়—
সে আগুন নিভে গেছে কবে
রেখে গেছে ক্ষুধা ঘৃণা,
শুধু লোভ, শুধু ক্ষোভ,
শুধু জীব, শুধু জড়, আর এক জড়ের জীবন।
এ যেন জন্ম নয় নতুন কিছুর,
শুধু কিছু সংখ্যার খুব দ্রুত বেড়েই চলা।
আর আমরা? আমরা তো ওদের তরেই
দিয়ে যাচ্ছি বিশ্বের বিস্ময়।
ওদের ঘাড়ের জন্য সুদর্শন লাশের স্তূপ,
ওদের মনের জন্য জটিল সাহিত্য,
ওদের মুখে উঠবে ঝলসানো লাল মাংস-
নয় ক্ষুধার শান্তি শুদ্ধ শুভ্র নিস্পাপ ভাত।
ওদের জিভের লালা ফুরাবে না।
ওদের পেটের ক্ষুধা দিনান্তে
ফুরাবে না।
পৃথিবীর যত মাতা, যত গর্ভ, সব আজ জ্বেলে দাও
আসন্ন উন্নতি বাড়াতে।
নীতিহীন উন্নতি তখন
জন্ম দেবে যন্ত্র-জন্তুর ।
আনো আরো জীবহীন জিভ,
গানে যারা উন্মাদ হবে না,
হাহাকারে ঘিরে যারা
ধীরে ধীরে ভুলবে চিৎকার।
১৬ অক্টোবর, ২০১১